পর্ব-৬
উনি চলে যাবার পর ইন্দ্রদাকে বললাম,"ওনার কথায় কিছু বুঝলে?"
"বুঝতে পারছি একটু-একটু, তবে কতটা সত্যি ভাবা দুঃসাধ্য। ছোট-ছোট clue গুলো মাথার সামনে ভিড় করছে। দেখি কাল বাংলোটায় ঘুরে, যদি কিছু সন্ধান পাওয়া যায়। সৌম্য, তোর কি মনে হয়, এমন এক ভুতুড়ে plan কারোর একার?"
"না। হয়তো অনেকজনেরই হাত আছে, কিন্তু motive একটাই।"
"কিন্তু সমু, আমার মনে হয় রাতের ঐ মায়াকাণ্ডের মূল পাণ্ডা একজনই..."
"কে সে?"
◕ কান্নাভেজা অতীত -
"দীপেন গাঙ্গুলী, হ্যাঁ আমার নাম।"
পরের দিন সকালবেলার ঘটনা। আমাদের সামনে breakfast টেবিলে বসে রয়েছেন ভজহরি বাবু, ইন্সপেক্টর রায়, আর একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক, চোখে হালকা পাওয়ারের চশমা, মুখে বিষণ্ণ হাসি, আর চোখের মণি দুটোর পেছনে চাপা অঙ্গার ধিকি-ধিকি করে জ্বলছে। ইন্দ্রদার জিজ্ঞাসাতে উনি ওনার নাম বললেন।
দীপেনবাবু বললেন, "আপনি তো কয়েকদিন আগে তিলপুরে মার্ডার কেসের সমাধান করতে গিয়েছিলেন। এখানে এসেছেন শুনলাম ইনস্পেক্টর রায়ের মুখে, তাই আপনার সাথে দেখা করতে চলে এলাম। এখানে সন্ধিগড়ে জঙ্গলের বাংলোটা নিয়ে তদন্ত করবেন শুনলাম?"
"You are right দীপেনবাবু। কিন্তু শুনলেন কথায়?"
ভদ্রলোক চশমাটা একটু নামিয়ে নিয়ে বললেন, "বাতাসেরও কান আছে মশাই।"
"আপনার বাড়িটা কোথায়?"
"আমি এখানে থাকি না, মাঝে-মাঝে আসি। দক্ষিণ পাড়ায় আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকি। দমদমে আমার অফিস। এখন তাহলে উঠি, পরে দেখা হবে ... জানি আপনাদের সময় কতটা মূল্যবান।"
দীপেনবাবু বেরোনোর কিছুক্ষণ পরেই আমরা ভোলাবাবার কাছে যাবো বলে ঠিক করলাম। ভজহরিবাবুর কাছে রাস্তার direction জেনে নিয়েছি। রোদটা এখনও স্পষ্ট নয়। প্রকাণ্ড নীলাকাশে ছোট-ছোট পাখির কিচির-মিচির... কোথাও মোরগ ডাকছিল... ঝিরঝিরে বাতাসে হাঁটতে-হাঁটতে মনে হচ্ছিল, শহুরে জীবনের monotony কাটাতে গ্রাম সত্যিই perfect. একপাল কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে রাস্তায় শুয়ে রয়েছে, দু'তিনটে কাক ডিঙ্গি মেরে ওদের টহল দিচ্ছে। একদল ছেলে পুকুরে উন্মত্ত ভাবে স্নান করে চলছে। ফুটিফাটা জংধরা পুরনো টিন, ভাঙ্গা টালি বা খড়ের চালের অগুনতি বাড়ি-ঘর গা জড়াজড়ি করে রয়েছে। বেশির ভাগ লোককে দেখেছি খালি গায়ে। আমাদের দেখে সবার চোখে অনন্ত কৌতূহল। হতদরিদ্র মানুষের বাসার মাঝে-মাঝে কোথাও জেগে উঠেছে পাকা বাড়িওয়ালা ভদ্রসমাজ। এদের দুর্দশা দেখে অন্তর্নিহিত একটা আক্ষেপ বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠে। পরে অবশ্য ইন্দ্রদা বলেছিল, কোলকাতার খোলা আকাশের নিচে, বর্ষায় ভিজে, হিমঋতুর অসহ্য চিন্তায় কুঁকড়ে, যারা অবধারিত মৃত্যুর দিন গোনে তাদের তুলনায় এদের অবস্থা অনেক স্বচ্ছল।
আমরা আমাদের গন্তব্যে এলাম। জায়গাটা ঘন ঝোপঝাড়ে ভর্তি, আর উঁচু-উঁচু প্রাচীন বৃক্ষে ঢাকা। একটাই মাত্র টালির চাল আর কাঁচা বাঁশের বেড়ার লম্বা ঘর উঠেছে। অনেকটা দূরে একটা নদীর হালকা নীল রেখা অনুভব করা যায়। ঐদিক থেকে কুড়ি একুশ বছরের এক গ্রাম্য মেয়েকে কলসী নিয়ে আসতে দেখলাম। আমাদের দিকেই আসছে; হু হু বাতাসে চুলগুলো উড়ে মুখে নেমে আসছিল। সৌন্দর্য যেন শরীরের ওপর রোলার চালিয়ে দিয়েছে। মেয়েটির পরনে আলখাল্লার মত একটা ছেঁড়া শালোয়ার। এক হাতে এলোমেলো কেশগুচ্ছ কানের পাশে সরিয়ে নিয়ে মেয়েটি আমাদের উদ্দেশ্যে বলল, "আপনারা কাউকে খুঁজছেন?"
ইন্দ্রদা অবাক বিস্ময়ে যুবতীর মুখের দিকে চেয়ে আছে, হয়তো মনে-মনে ওর একটা চাক্ষুষ জরিপ সেরে নিচ্ছে।
সায়ন রায় বলে উঠলেন, "ভোলাবাবা বলে কি এখানে কেউ থাকেন?"
"হ্যাঁ, আসুন আপনারা।"
মেয়েটির সাথে আমরা তিনজন টালির ঘরে এলাম। খুব সাধারণ পরিবার। কাঠের একটা তক্তপোশে শুয়েছিলেন ভোলাবাবা, সর্বাঙ্গ সাদা চাদরে ঢাকা। চুল-দাঁড়ি সব সাদা, এমনকি ভ্রু ও পাতার লোমগুলো পর্যন্ত; বোঝাই যাচ্ছে বয়সের ঝড়-ঝাপটায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন।
"বাবা তোমার সাথে কয়েকজন ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন।"
"আমরা CID Kolkata" থেকে এসেছি। আপনাদের সন্ধিগড় জঙ্গলের ঐ ডাকবাংলোটা সম্পর্কে আপনি যদি কিছু আলোকপাত করেন?"
"কেন টেনে আনছেন যন্ত্রণাদীর্ণ কান্নাভেজা অতীত! ওদের ধরা যায় না, মৃত্যুর শীতল কোলে ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের জাগানো ঠিক নয়।"
অর্থগুলো ধোঁয়াটে মনে হয়, কেমন দার্শনিকের মন্তব্যের মত শোনায়। মন্ত্রমুগ্ধের মত স্তব্ধ হয়ে গেছি বৃদ্ধের সজীব ও সতেজ চোখের তারা দুটোর ওপর দৃষ্টিপাত করে। ইতিমধ্যে সেই মেয়েটি আমাদের জন্য লেবুর সরবত করে নিয়ে এল। সায়ন রায় একটু ইতস্তত করছিলেন। বৃদ্ধ বললেন, "খান-খান। বিষ মেশানো নেই সরবতে, জানি আপনাদের মন সব সময় সন্দেহ-প্রবণ। এই আমার মেয়ে নয়ন। আমি আর নয়নই এখানে থাকি।"
মনে-মনে ভাবলাম, কে বলে এরা গ্রাম্য অশিক্ষিত? নয়নের পরনে থাকতে পারে মরচে রঙের জীর্ণ শালো
য়ার, কিন্তু এমন সুমার্জিত অতিথিপরায়ণতা ক'জনের আছে?
@Anshhi @Uronchondi @Bhoot @Maity Adi @misstti @Ladywiththelamp @Ankita @Anshh3 @ANNA007 @InkyWhispers